
বাংলা একাডেমি সংস্কারে যে কমিটি গঠন করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, সেই কমিটি কতটা আইন মেনে হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
ভাষা আন্দোলনের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া বাংলা একাডেমি দিনে দিনে এমন এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, যেখানে অধিকাংশ মহাপরিচালকই ছিলেন রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং চেয়ারের প্রতি অতিশয় অনুগত। ফলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও নিয়োগদাতা দলকে খুশি রাখতে তোষামোদকে সাহিত্যে পরিণত করেছেন তারা।
লেখক ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলা একাডেমি সংস্কারের জন্য একটি কমিটি তৈরি হয়েছে এ মাসের ৭ জুলাই। এই কমিটি তৈরি করেছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যে মন্ত্রণালয়টি বেশ কিছু দিন ধরে নিত্যই বিতর্কিত হচ্ছে—কখনও বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান নিয়ে, কখনও বা শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদত্যাগ ঘিরে। এমনকি চলচ্চিত্র অনুদানের মতো বিষয়েও, যেখানে মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্ব নেই, সেখানেও তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
১৯৮৯ সালের আইনে শিল্পকলা একাডেমিকে একটি ‘সংবিধিবদ্ধ সংস্থা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেই আইনে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, “শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ পরিচালনা ও প্রশাসন একটি পরিষদের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং পরিষদ সেই সব ক্ষমতা প্রয়োগ ও কাজ করতে পারবে, যা একাডেমি কর্তৃক প্রযুক্ত ও সম্পন্ন হইতে পারে।” কিন্তু বর্তমানে মহাপরিচালকের পদ খালি থাকায় একাডেমি কার্যত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে পরিষদকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি পরিষদের সভাপতি এবং আইন অনুযায়ী সভা আহ্বানের দায়িত্বও তার ওপর ন্যস্ত। অথচ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি মাত্র একবার সভা ডেকেছিলেন, যেখানে আইন অনুযায়ী প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তত একটি সভা হওয়ার কথা। বিশেষ প্রয়োজনে অতিরিক্ত সভা ডাকার এখতিয়ারও তার রয়েছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদের পদত্যাগ বড়সড় আলোড়ন সৃষ্টি করলেও উপদেষ্টা কোনও সভা ডাকেননি। বরং বিগত চার মাসে একাডেমিকে আরও বেশি করে মন্ত্রণালয়ের করায়ত্ত ও তল্পিবাহক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এর আগে দীর্ঘদিন মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল—তিনি নানাভাবে দুর্নীতি করেছেন এবং একাডেমির পরিষদকে কোনো গুরুত্বই দেননি।
একই অবস্থা বাংলা একাডেমির। বাংলা একাডেমি আইনেও বলা আছে, ‘একাডেমির সর্বময় কর্তৃত্ব সাধারণ পরিষদের ওপর ন্যস্ত থাকবে। সাধারণ পরিষদ একাডেমির কার্যাবলি তদারকি ও পর্যালোচনা করবে এবং নির্বাহী পরিষদকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেবে।’
কিন্তু বাংলা একাডেমি সংস্কারে যে কমিটি গঠন করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, সেই কমিটি কতটা আইন মেনে হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, ফেলো, জীবন সদস্যদের অনেককে না জানিয়েই কমিটি করা হয়েছে। কমিটিতে কয়েকজন সদস্য হয়েছেন; যারা একাডেমির সাধারণ সদস্যও নন। তাদের নিয়ে বাংলা একাডেমি সংস্কার কমিটি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
বাংলা একাডেমির স্বায়ত্তশাসিত চরিত্র নষ্ট করার প্রক্রিয়া অবশ্য আরও আগে থেকেই চলে আসছে। মন্ত্রণালয় নানাভাবে বাংলা একাডেমিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। বর্তমানেও এর ব্যত্যয় ঘটছে না।
বাংলা একাডেমির সংস্কার কমিটি নিয়ে দুবার সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। কিন্তু আহূত ওই সম্মেলনগুলো কার্যত ভেস্তে যায়, কারণ সাংবাদিকদের উপস্থিতিই ছিল না বললেই চলে। ফলে দুই মাস পেরিয়ে গেলেও সংবাদ সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমেই সংস্কার কমিটির নাম প্রকাশ করতে বাধ্য হয় মন্ত্রণালয়।
সংস্কার কমিটির নাম ঘোষণা নিয়ে বিতর্কের কিছুদিন আগে আমরা লক্ষ্য করেছি, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে এবার যে চলচ্চিত্র অনুদান ঘোষণা করা হয়েছে, তা নিয়েও বিতর্ক উঠেছে। বিতর্ক থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রেহাই মিলেনি। অনুদান কমিটির সঙ্গে যুক্ত লোকজনও অনুদান পেয়েছেন। একদিনে ৯৫জন আবেদনকারীর সাক্ষাৎকার নিয়ে ‘ইতিহাস’ গড়েছে অনুদান কমিটি। ফলে অনুদানের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনুদান কমিটি থেকে তিনজন সদস্য বিভিন্ন সময় পদত্যাগও করেছেন।
পরে সেখানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দপ্তর নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক লতিফুল ইসলাম শিবলীকে অনুদান কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শিবলী মূলত গীতিকবি। নজরুল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হয়েও তিনি কি করে নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন, তা নিয়েই যেখানে প্রশ্ন আছে। এমনকি, চলচ্চিত্র অনুদান কমিটিতেও তাকে যুক্ত করা হয়েছে। অথচ তিনি তো চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞও নন।
শিল্পকলা একাডেমি থেকে নজরুল ইনস্টিটিউট পর্যন্ত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ নিয়ে খুব কথা না হলেও, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়া বাংলা একাডেমিতে হস্তক্ষেপে সর্বদাই বিরক্ত হয়েছে মানুষ। যদিও বাংলা একাডেমিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ ও ছড়ি ঘোরানো নতুন কিছু নয়। নানা সময়ে তারা সুযোগ পেলেই এই কাজটা করেছে। কেবল মনজুরে মওলা, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, হারুন-উর রশীদ, সৈয়দ আনোয়োর হোসনে ও শামসুজ্জামান খানের সময়ে এই কাজটি করতে তারা সাহস পাননি। উল্লিখিত প্রথম দুজনের প্রখর ব্যক্তিত্বের সামনে হস্তক্ষেপ তো দূরের কথা, ওরকম কিছু ভাবারও সাহস করেনি মন্ত্রণালয়। শামসুজ্জামান খানের সময় করতে পারেননি শেখ হাসিনার সঙ্গে তার সুসম্পর্কের কারণে।
এ যাবৎ একাডেমির বেশিরভাগ মহাপরিচালকই ছিলেন রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত, ফলে তারা সারাক্ষণ পদ হারাবার ভয়ে নিয়োগদাতা রাজনৈতিক দল ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তোষামোদ করে চলেছেন।
বিএনপি আমলে নিয়োগ পাওয়া মহাপরিচালকরাও ওরকমটি করেছেন, আর সর্বশেষ আওয়ামী আমলের শামসুজ্জামান খান, হাবিবুল্লাহ সিরাজী ও মুহম্মদ নূরুল হুদা নির্লজ্জভাবে সেটা করেছেন বলেই দৃশ্যমান হয়। শামসুজ্জামান খান মন্ত্রণালয়ের কাছে মাথা নোয়াননি বটে, তবে শেখ হাসিনাকে খুশি করার জন্য বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, দুধের শিশু রাসেলকে নিয়েও অপ্রয়োজনীয় বহু বই বের করেছেন। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, মুহম্মদ নূরুল হুদাই বাংলা একাডেমিকে সবচেয়ে বেশি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ‘ঘেটু’ বানিয়েছেন।
আশা করা গিয়েছিল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে গুণগত পরিবর্তন আসবে। কিন্তু তা আসেনি। বাংলা একাডেমির ওপর রাজনৈতিক ক্ষমতার বদল ঘটেছে মাত্র, এর চরিত্রের বদল ঘটেনি মোটেই। তা যে ঘটেনি, তারই প্রমাণ এই কমিটি গঠন। মোহাম্মদ আজম রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুবাদে মহাপরিচালক হয়েছেন। তিনি কি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এই হস্তক্ষেপ ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন? এই হস্তক্ষেপ মোহাম্মদ আজমের জন্য যেমন অসম্মানজনক, তেমনি বাংলা একাডেমির জন্যও অবমাননাকর।
বাংলা একাডেমি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্র তথা নিজস্ব বিধি ও নীতিমালা রয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এখানে হস্তক্ষেপ বা খবরদারি করার কোনো সুযোগই নেই। কিন্তু তারপরও এই সুযোগ নিয়োগপ্রাপ্ত মহাপরিচালকরাই করে দেন পদ ও ক্ষমতার লোভে। বাংলা একাডেমির যদি কোনো সংস্কার প্রয়োজন হয়, তা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার নিজের ভেতর থেকেই ঘটা উচিত, মন্ত্রণালয় থেকে ওই কাজটি করা উচিত নয়। এতে বাংলা একাডেমির সার্বভৌম বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ণ হয় এবং তা প্রতিষ্ঠানটির জন্য অসম্মানের। তাছাড়া, বাংলা একাডেমির আদৌ সংস্কারের প্রয়োজন আছে কিনা—প্রশ্ন সেটাও।
কেন মনে হলো এই প্রতিষ্ঠানের সংস্কার প্রয়োজন? কারণ বাংলা একাডেমি তার নির্ধারিত কাজগুলো করছে না। ক্ষমতাসীন দল ও ব্যক্তিবর্গের তোষামোদ করতে গিয়ে একাডেমি তার কর্তব্য থেকে সরে গেছে অনেকদিন আগে থেকেই। কিন্তু একাডেমি যদি মেধাবী ও প্রতিভাবান লেখকদের গবেষণাকর্ম, গুরুত্বপূর্ণ মননশীল গ্রন্থ প্রকাশ, অনুবাদ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে সঠিক ভূমিকাটি পালন করত, তাহলে এই সংস্কারের প্রশ্নটি দেখা দিত না। অর্থাৎ, একাডেমি তার নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করছে না বলেই, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মনে হয়েছে, এর সংস্কার দরকার। কিন্তু বিষয়টা যে সংস্কারের নয়, বরং একাডেমির কর্তব্যগুলো স্মরণ করিয়ে দেওয়ার—এই কথাটা আমরা ভুলে যাচ্ছি কেন?
সংস্কার করলেই এই প্রতিষ্ঠান ভালোভাবে চলবে? এমন নিশ্চয়তাই বা কোথায়! মহাপরিচালক যদি তার দায়িত্ব পালন না করেন, তাহলে সংস্কারেও কোনো কাজ হবে না। তাছাড়া, এই প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের কিছু নেই। যেটা প্রয়োজন তা হলো, এই প্রতিষ্ঠানে সৎ, যোগ্য ও পক্ষপাতহীন মহাপরিচালক। বাংলা একাডেমির নীতিমালা বা যেসব বিধান রয়েছে ওসবকে কার্যকর করাই হবে আসল সংস্কার। সেটা করলে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া সংস্কারের আর প্রয়োজন হয় না।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তাহলে কেন সংস্কারের কথা বলে কমিটি গঠন করছে? কারণ মহাপরিচালকের নতজানু চরিত্রই মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ করে দেয়। এর নজির আমরা সর্বশেষ সাহিত্য পুরস্কারের সময়ও দেখেছি। বাংলা একাডেমির ইতিহাসে সেটি এক কলঙ্কচিহ্ন, যা মহাপরিচালক ঘটতে দিয়েছেন। একইভাবে এবার মোহাম্মদ আজম এই সংস্কারের কাজটিও ঘটতে দিলেন। যেন বাংলা একাডেমি যথেষ্ট সক্ষম নয়, কিংবা তার বিধিবিধানের এমন ঘাটতি রয়েছে যে এখন বাইরে থেকে লোক এনে এর সুরাহা করতে হবে।
মোহাম্মদ আজম যে জিনিসটি বুঝতে পারছেন না তাহলো, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নামক শেয়ালকে তিনি ভাঙ্গা বেড়া দেখিয়েছেন, এখন সে এখান থেকে বারবার মুরগি নিয়ে যেতে থাকবে। এই যে ১৯ জন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে এটা আসলে বাংলা একাডেমিকে অকার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রমাণ করার একটা উদাহরণ তৈরি করা, আর এই অকার্যকর প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মোহাম্মদ আজম সেটা করতে দিলেন। এই ব্যাপারটা মোহাম্মদ আজমের জন্য মোটেই গৌরবের নয়।
যুক্তরাষ্ট্র যেমন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অজুহাতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সামরিক অভিযান চালায়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণে ঠিক ওই কাজটাই করতে যাচ্ছে সাহিত্যের সিপাহসালার ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৯ জন সাহিত্যসেনা নিয়ে। এই কমিটিতে কারা আছেন? বেশ কয়েকজন গুণীজন থাকলেও, তাদের মধ্যে এমন কয়েকজন আছেন যারা বাংলা একাডেমির পুরস্কার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত। এমন কয়েকজন আছেন, যাদের ওই ভূমিকায় দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এ ধরনের ব্যক্তিদের এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্যকে নিশ্চিতভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
অন্য আরও যে কজন আছেন তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে হয়তো যোগ্য, কিন্তু বাংলা একাডেমির মতো জাতির মননের প্রতীক একটি প্রতিষ্ঠান ও তার সংস্কার করার যোগ্যতা তাদের আদৌ আছে কিনা এই প্রশ্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ তুলতেও শুরু করেছেন।
কেউ কেউ বলছেন, বাংলা একাডেমির প্রতি তাদের দরদ দেখানোর আগে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উচিত নিজেদের যত অপকর্ম ও দুর্নীতি আছে, সেসবের সংস্কার করা। নিজে সুনাম অর্জন করার পরই কেবল অন্য কাউকে ভালো হওয়ার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে।
গত পনের-ষোল বছরে বাংলা একাডেমি রাজনৈতিক দলের এতটাই তোষণ করেছে যে এসব অনেকেই ভালো চোখে দেখেননি, দেখার কথাও নয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে নতুন যারা এসেছেন, তারা নতুন রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুবিধাভোগী এবং নিশ্চিতভাবে তারা আওয়ামীবিরোধী। বাংলা একাডেমি যেহেতু গত পনের-ষোল বছর ওই সরকারের তোষণ করেছে, এটা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নতুনদের কাছে অত্যন্ত ক্ষোভের কারণ হয়ে আছে। বাংলা একাডেমির ওপর নিয়ন্ত্রণ ও খবরদারি করা ছাড়াও, এই সংস্কারের মাধ্যমে তারা ওই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন।
এটা ঠিক যে বাংলা একাডেমিতে বহু সমস্যা আছে, আছে দুর্নীতিও—নানা মাত্রার এবং প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ ধরনের। কার্পেটের তলায় যেমন, তেমনি কার্পেটের ওপরেও অনেক ময়লা জমে আছে। আছে আজ্ঞাবহ দাস থেকে শুরু করে চাটুকারও। আগের মহাপরিচালকদের মাধ্যমে জায়গা পাওয়া সুবিধাবাদী এবং অসৎ চরিত্রের লোকজনও কম নয়।
বলতে গেলে অযোগ্য ও অসৎ লোকদের আখড়া হয়ে উঠেছে মননশীলতার প্রতীক এই প্রতিষ্ঠানটি। এবং ওই ধারাবাহিকতা এখনও অব্যাহত। কিন্তু একাডেমির এইসব ব্যাধির উপশম একাডেমির বিধিমালার মধ্যেই আছে যদি তা প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা যায়।
আমি মনে করি বাংলা একাডেমির ওপর ছড়ি ঘোরোনো বন্ধ করলেই বরং এটি স্বাধীনভাবে ভালো কাজ করতে পারবে। বাংলা একাডেমির ক্ষেত্রে যেটা করা প্রয়োজন তাহলো একাডেমি যা কিছুই করুক না কেন তা নিজেদের স্থায়ী কাউন্সিল বা চার সদস্যের একটি কমিটির মাধ্যমে অনুমোদন করিয়ে নেওয়া। বাংলা একাডেমির যে কোনো কার্যক্রমের জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত করা। তারা প্রতি মাসে কিংবা প্রতি তিন মাসে, কিংবা প্রতি ছয় মাসে প্রেস কানফারেন্স করে এই সময়কালে বাস্তবায়িত কার্যক্রম এবং ভবিষ্যৎ কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করবে। এবং প্রকাশ্যে প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেবে। এইভাবে বাংলা একাডেমি সত্যিকারের গণমুখী ও গণতান্ত্রিক একটি চরিত্রও অর্জন করতে পারবে। পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি কোনো আমলানির্ভর প্রতিষ্ঠানের কাছে নয়, বরং সরাসরি জনগণের কাছে তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।
বাংলা একাডেমি যাতে বইয়ের বিষয়গত মান ও মুদ্রণ সৌকর্যসহ নির্ভুল বই প্রকাশ করতে পারে, ওই দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। বই বিপণনের ক্ষেত্রে তাদের আরও বেশি উদ্যোগী হওয়া দরকার। বাংলা একাডেমির বই তাদের বিক্রয় কেন্দ্র থেকেই কেবল নয়, যে কেউ যেন যে কোনো সময় তা কিনতে পারে, ওইরকম একটি অনলাইন বিক্রয় কেন্দ্র তৈরি করা উচিত। আমি যেসব বলছি এগুলো একাডেমির নিজেদের লক্ষ্যের মধ্যেই আছে। কিন্তু বাস্তবায়নের অভাবে তা সুপ্ত হয়ে আছে। বাংলা বানানের একটি অ্যাপস তৈরির কাজ তারা হাতে নিতে পারে। অনলাইনে বিনামূল্যে তা ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে নির্ভুল বাংলা চর্চায় বাংলা-জানা ও এই ভাষায় আগ্রহীদেরকে উৎসাহিত করতে পারে। এতে করে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিস্তার যেমন ঘটবে, তেমনি তা ভাষার প্রতি মমতাও তৈরি করতে সহযোগিতা করবে।
একাডেমির উচিত এসব দিকে নজর দেওয়া। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে মান ও গুণ বিচারে কোনোরকম শৈথিল্য না দেখানো। স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক পক্ষপাত ও ব্যক্তিপূজা থেকে বাংলা একাডেমিকে মুক্ত রাখা উচিত। আরও একটা বিষয়ও বাংলা একাডেমির করা উচিত: পুরস্কার কমিটিতে কারা থাকেন এবং কারা সুপারিশ করছেন তাদের নামও পুরস্কার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জনসমক্ষে আনার বিধান করা। পুরস্কার কমিটির নামে অজ্ঞাতে কারা পুরস্কারের কলকাঠি নাড়ছেন, কারা তদবির করছেন, তা সাধারণ জনগণের জানার অধিকার রয়েছে।
বাংলা একাডেমি যাতে কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতি পক্ষপাত না দেখায় এবং সুবিধা প্রদানের কর্মকাণ্ডে না জড়িয়ে পড়ে, ওই ব্যাপারগুলো নিশ্চিত করতে হবে। বাংলা একাডেমি যেন কোনো প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়ের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বায়ত্তশাসিত চরিত্র ও গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারে, ওই দিকটি বিবেচনায় আনা বেশি জরুরি।
এসব না করলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সংস্কারের অজুহাতে বাংলা একাডেমির ওপর তাদের আধিপত্য বিস্তারের এই রকম অশুভ হস্তক্ষেপ অব্যাহত রাখবে। যখনই অযোগ্য, অসৎ ও তোষণচরিত্রের কেউ মহাপরিচালক হবেন, তখন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বাংলা একাডেমির ঘাড়ের ওপর চড়ার সুযোগ বেশি নেবে। আমাদের দরকার যোগ্য ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বিদ্বান মানুষ।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে না বাংলা একাডেমির ওপর মোড়লগিরি করা, এটা করার কোনো নৈতিক অধিকারও তাদের নেই।