দারসুল কোরআন

2* وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ ۖ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ ﴿١٣﴾ وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَىٰ وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ ﴿١٤﴾ وَإِن جَاهَدَاكَ عَلَىٰ أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا ۖ وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا ۖ وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ۚ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ ﴿١٥﴾ يَا بُنَيَّ إِنَّهَا إِن تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ فَتَكُن فِي صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَاوَاتِ أَوْ فِي الْأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ ﴿١٦﴾ يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنكَرِ وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا أَصَابَكَ ۖ إِنَّ ذَٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ ﴿١٧﴾ وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ ﴿١٨﴾ وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ ۚ إِنَّ أَنكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ ﴿١٩﴾ অনুবাদ- ১৩. (হে নবী, স্মরণ করো) যখন লোকমান তার ছেলেকে নসীহত করতে গিয়ে বললো, হে বৎস আল্লাহ তায়ালার সাথে শিরক করোনা (কেননা) শিরক হচ্ছে সবচাইতে বড়ো যুলুম।১৪. আমি মানুষকে (তাদের) পিতামাতার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছি, (যেন তারা তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করে) কেননা তার মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে এবং দুই বছর পর সে বুকের দুধ খাওয়া ছেড়েছে, তুমি (সৃষ্টির জন্য) আমার শোকর আদায় করো এবং তোমার (লালন পালনের জন্য) পিতা মাতার ও কৃতজ্ঞতা আদায় করো, (অবশ্য তোমাদের সবাই) আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে।১৫. যদি তাঁরা উভয়ে তোমাকে এই বিষয়ের উপর পীড়াপিড়ি করে যে তুমি আমার সাথে শিরক করবে, যে ব্যাপারে তোমার কোন জ্ঞানই নেই, তাহলে তুমি তাদের দু’জনের (কারোরই) কথা মানবে না, তবে দুনিয়ার জীবনে তুমি অবশ্যই তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে, তুমি শুধু তার কথাই শুনবে, যে আমার অভিমুখী হয়ে আছে, অতঃপর তোমাদের আমার দিকেই ফিরে আসতে হবে, তখন আমি তোমাদের বলে দেবো তোমরা দুনিয়ার জীবনে কি কি কাজ করতে।১৬. লোকমান আরো বললো হে বৎস, যদি (তোমার) কোনো আমল সরিষার দানা পরিমাণ (ছোট ও) হয় এবং তা যদি কোনো শিলাখন্ডের ভেতর কিংবা আসমান সমূহেও (লুকিয়ে) থাকে, অথবা (যদি তা থাকে) যমীনের) ভেতরে তাকাও আল্লাহ তায়ালা সামনে এনে হাযির করবেন, আল্লাহ তায়ালা সূক্ষ্মস্পর্শী এবং সকল বিষয়ে সম্যক অবগত।১৭. (লোকমান আরো বললো,) হে বৎস, তুমি নামায প্রতিষ্ঠা করো, মানুষদের ভালো কাজের আদেশ দাও, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখো, তোমার উপর কোন বিপদ মুসিবত এসে পড়লে তার উপর ধৈর্য্যধারণ কর, এই কাজটি নিঃসন্দেহে একটি বড়ো সাহসিকতাপূর্ণ কাজ।১৮. (হে বৎস) কখনো অহংকার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং (আল্লাহর) যমীনে কখনো ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে বিচরণ করোনা, কেননা আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক উদ্ধৃত অহংকারীকে অপছন্দ করেন।১৯. (হে বৎস, যমীনে চলার সময়) তুমি মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো, তোমার কণ্ঠস্বরকে নিচু রাখো, কেননা সব আওয়াজের মধ্যে সবচাইতে অপ্রীতিকর আওয়াজ হচ্ছে গাধার আওয়াজ।* নামকরণ–সুরার দ্বিতীয় রুকুতে অর্থাৎ আলোচ্য রুকুতে লুকমান হাকীমের উপদেশাবলী উদ্ধৃত করা হয়েছে। এ থেকেই সূরার লুকমান নামকরণ করা হয়েছে।* শানে নুযুল– সুরাটি মাক্কী সূরার আলোচনা ও বিষয়াদি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে মনে হয়, যখন ইসলামী দাওয়াতকে দমন ও প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে বিরোধীদের তরফ হইতে অত্যাচার ও নিপীড়ন শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু বিরুদ্ধতার তুফান তখনো পূর্ণমাত্রায় তীব্র ও কঠিন হয়ে উঠেনি। তখনই এ সূরাটি নাযিল হয়। ১৪-১৫ আয়াতে বিষয়টির আভাস পাওয়া যায়। সেখানে ইসলামে নবদীক্ষিত যুবকদেরকে বলা হয়েছে, আল্লাহর পরে পিতামাতার অধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারা যদি ইসলামে দীক্ষিত হতে বাধা দেয় এবং শিরক করতে বলে তাহলে তাদের কথা কখনোই মেনে নেবে না। সূরা আনকাবুতেও একই কথা বলা হয়েছে এ থেকে জানা যায়, সূরা দুটি একই সময়ে নাযিল হয়েছে।*উভয় সুরার বর্ণনা রীতি ও বিষয়বস্তুর কথা চিন্তা করলে অনুমান করা যায়, সুরা লোকমান প্রথমে নাযিল হয়। কারণ এতে তীব্র আকারের বিরোধীতার চিহ্ন পাওয়া যায় না। বিপরীত পক্ষে সূরা আনকাবুত পড়লে মনে হবে তার নাযিলের সময় মুসলমানদের ওপর কঠোর জুলুম নিপীড়ন চলছিল।সুতরাং বলা যায়, সূরা লোকমান রাসূল (সঃ) এর মাক্কী জীবনের দ্বিতীয় স্তরে নাযিল হয়। **আলোচ্য বিষয়- ১. শিরক অর্থহীন, অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন ব্যাপার। তাওহীদ একমাত্র সত্য ও যুক্তিসম্মত আদর্শ।২. বাপ-দাদার অন্ধ অনুকরণ ও অনুসরণ পরিত্যাগ করে মুহাম্মদ (সঃ) এর আদর্শকে উন্মুক্ত মনে চিন্তা বিবেচনা করে তা গ্রহণের দাওয়াত দেয়া হয়েছে।৩. হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর দাওয়াত কোন নতুন আওয়াজ নয়, পূর্বের জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন লোকেরাও এ কথাই বলত-যেমন হযরত লোকমান।৪. আল্লাহ সর্বদ্রষ্টা, সূক্ষ্মদর্শী ও সকল বিষয়ে সম্যক অবগত।৫. নামায কায়েম, ইসলামী আন্দোলন মুমিনের বৈশিষ্ট্য বিপদে মুসিবতে ধৈর্য্যধারণ করা বড়ো সাহসিকতাপূর্ণ কাজ।৬. অহংকার।৭. মধ্যপন্থা অবলম্বন। হযরত লোকমান এর পরিচয় :- **লোকমান হাকীম আরব সমাজে একজন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী হিসেবে বহুল পরিচিত ব্যক্তি। ইমরাউল কায়েস, লবীদ আশা, তারাফাহ প্রমুখ জাহেলী যুগের কবিগণ তাদের কাব্যে লুকমানের নাম উল্লেখ করেছেন। আরবের কোন কোন লোকের কাছে “সহীফা লুকমান” নামক তাঁর জ্ঞানগর্ভ উক্তির একটি সংকলন পাওয়া যেত।**ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে লুকমানের ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে অনেক মতভেদ রয়েছে। জাহেলী যুগে কোন লিখিত ইতিহাসের অস্তিত্ব ছিলনা। মুখে মুখে চলে আসা তথ্যই ছিল ইতিহাস।**ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বেহের বর্ণনানুযায়ী লোকমান হযরত আইয়্যুব (আঃ) এর ভাগ্নে ছিলেন। **তাফসীর দুররে মনসুরে হযরত ইবনে আব্বাসের (রাঃ) বর্ণনানুযায়ী লোকমান একজন আবিসিনীয় হাবশী গোলাম। হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) ইকরিমাহ ও খালেদুর রাবে-ঈ ও একই কথা বলেন। হযরত যাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী (রাঃ) বলেন- তিনি ছিলেন নুবার অধিবাসী। সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব বলেনÑ তিনি মিসরের কালো লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনটি বক্তব্য প্রায় কাছাকাছি। আরবের লোকেরা সেকালে কালো লোকদেরকে প্রায়ই হাবশী বলত। আর নুবা হচ্ছে মিসরের দক্ষিণে ও সুদানের উত্তরে অবস্থিত এলাকা। লুকমান হাকীম ও লুকমান ইবনে আদ দু’জন আলাদা ব্যক্তি। **হযরত যাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেনÑ লুকমান চ্যাপটা নাকবিশিষ্ট, বেঁটে আকারের আবিসিনীয় ক্রীত দাস ছিলেন। মুজাহিদ (রঃ) বলেন “তিনি ফাটা পা ও পুরো ঠোঁটবিশিষ্ট আবিসিনীয় ক্রীতদাস ছিলেন। – ইবনে কাসীর।হযরত লোকমান কোন নবী ছিলেন না, ওলী প্রজ্ঞাবান ও বিশিষ্ট মনীষি ছিলেন। – ইবনে কাসীর, ইমাম রাগবী। কেবল ইকরিমা (রাঃ) মণিষী থেকে বর্ণিত যে তিনি নবী ছিলেন। কিন্তু এটি সনদের দিক থেকে দুর্বল।ইবনে কাসীর (রঃ) বলেনÑ হযরত কাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত- আল্লাহ পাক হযরত লুকমানকে নবুওত ও হেকমত (প্রজ্ঞা) দু’য়ের মধ্যে যে কোন একটি গ্রহনের সুযোগ দেন। তিনি হিকমত গ্রহণ করেন।কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে- “যদি আমার প্রতি এটা (নবুয়ত) গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়ে থাক, তবে তা শিরোধার্য, অন্যথায় আমাকে ক্ষমা কর।কুরতুবীতে আছে, ‘মহাত্মা লোকমান হযরত দাউদ (আঃ) এর আবির্ভাবের পূর্বে মাসআলাসমূহ সম্পর্কে ফতোয়া দিতেন। এক প্রশ্নোত্তরে তিনি মর্যাদা লাভের কারণ বলেনÑ ১. সর্বদা সত্য বলা ২. অপ্রয়োজনীয় কথা পরিহার করা। হযরত লোকমানের উপদেশসমূহ ১.আল্লাহর সাথে শরীক না করা । ২. পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহার । ৩. নামাজ কায়েম করা। ৪. সৎ কাজের আদেশ-অসৎ কাজের নিষেধ। ৫. ধৈর্য্য ধারণ (সবর)। ৬. সামাজিক শিষ্টাচার ঃ (অহংকার না করা)। ৭. মধ্য পন্থা অবলম্বন। ৮. কণ্ঠস্বর নিচু করা।ক.আল্লাহর সাথে শরীক না করা ঃশিরক শব্দের অর্থ অংশীদার। মানুষ পৃথিবীতে কোন কাজে তিন কারণে অংশীদারীত্ব করে।ক. পুঁজির অভাব খ. আংশিক পুঁজির অভাব, গ. সংশ্লিষ্ট কাজে জ্ঞানের অভাব।যেহেতু আল্লাহ উপরোক্ত দুর্বলতামুক্ত; তাই আল্লাহর সাথে শরীক করা চরম দৃষ্টতার শায়িল এবং চরম বোকামী কেননা যে শিরক করে, পক্ষান্তরে সে প্রমাণ করতে চায়, অখখঅঐ (ঝড) স্বয়ং সম্পূর্ণ নন (নাউজুবিল্লাহ) এবং তাঁর মধ্যে পরমুখাপেক্ষীতা রয়েছে। (নাউযুবিল্লাহ)শিরক মহাযুলুম। কারণ এর দ্বারা কোন ব্যক্তি এমন এক জিনিসকে/ বস্তুকে সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা ও নেয়ামতদাতা মহান আল্লাহর সামনে দাঁড় করায়, যার এসব ব্যাপারে একবিন্দু ক্ষমতা নেই, আল্লাহর হক হল- মানুষ শুধু তাঁরই ইবাদত করবে।অর্থ ঃ আমি জ্বিন ও মানব জাতিকে আমার ইবাদত ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি।- আয যারিয়াহ ৫৬** শিরক দুই প্রকার ঃ০১. আকীদাগত শিরক০২. লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সৎ কাজ করা। ০১. আকীদাগত শিরক ঃকাউকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা এবং তার ইবাদত করা। গাছ, পাথর, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, ফিরিশতা, নবী, ওলী ইত্যাদি যাই হোক না কেন, তাকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা ও তার ইবাদত করা শিরক।০২. লোক
ধর্মীয় জীবন বনাম জাগতিক জীবনে … মানুষ উল্টো রথে!

পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষের ধর্ম আছে … ধর্মীয় জীবনকে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায় ১. ইহকাল, ২. পরকাল। ইহকাল সংক্ষিপ্ত জীবন, জন্মমাত্রই মৃত্যু অবধারিত। যে কোন মুহূর্তে প্রত্যেক প্রানীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবেই। চলে যেতে হবে পৃথিবীর অর্থ-সম্পদ, মায়া-মমতা সবকিছু ছেড়ে … পক্ষান্তরে ধর্মমতে মানুষের বিশ্বাস পরকাল সীমাহিন অনন্ত জীবন। ইহকালে ধর্ম মেনে চলে ভাল কাজ করলে পরকালের অনন্ত জীবন শান্তিতে থাকা যাবে। আবার কোন কোন ধর্মমতে মৃত্যুর পর মানুষ আবার পৃথিবীতে পুনঃ জন্ম হবে, তবে ইহকালের কর্মের উপর নির্ভর করে হয়তো মানুষ, না হয় কোন শঙ্খচিল হয়ে জন্ম নেবে। সেইমতে ধর্ম জীবনে ইহকালের চাইতে পরকালের গুরুত্ব বেশি। জাগতিক জীবনকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় … ১. অতীত, ২. বর্তমান, ৩. ভবিষ্যৎ। অতীতের প্রাপ্তি থেকে বর্তমান জীবনে সুখ সমৃদ্ধি। বর্তমানের সঞ্চিত সম্পদ ভবিষ্যতের সুখ সমৃদ্ধি। কিন্তু ভবিষ্যতে যে সুখ সমৃদ্ধি ভোগ করতে পারবে তার কোন নিশ্চয়তা নাই। যেহেতু মৃত্যু পিছনে লেগে আছে, সেহেতু যে কোন মুহূর্তে মৃত্যুর ডাকে সাড়া দিতেই হবে, চলে যেতে হবে সঞ্চিত সব অর্থ সম্পদ ছেড়ে। সেই হিসেবে জাগতিক জীবনে ভবিষ্যতের চাইতে বর্তমানের গুরুত্ব বেশী। এখন দেখা যাক মানুষের কাছে কোনটার গুরুত্ব বেশী। জাগতিক জীবনে দেখা যায় মানুষ বর্তমানের কথা ভুলে ভবিষ্যৎ চিন্তা নিয়ে বেশী মগ্ন থাকে। কোটিপতি হওয়া, বাড়ী – গাড়ী করা, ইত্যাদি ইত্যাদি চিন্তা করে অর্থ সঞ্চয় করতে করতে বর্তমান ভোগের কথা মানুষ ভুলেই যায়। অথচ ভবিষ্যতে সেটা ভোগ করতে পারবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নাই। মৃত্যুর ডাকে এক মুহূর্তের মধ্যে সব শেষ হয়ে যেতে পারে। পক্ষান্তরে ধর্মমতে ধর্মীয় জীবনে ইহকালের সমস্ত কর্ম সঞ্চিত পরকালের জন্য জমা থাকবে … মৃত্যুর পর এটা ভোগ করতে পারার নিশ্চয়তা আছে। এটা জানা এবং বিশ্বাস করা স্বত্বেও মানুষ চলে উল্টো পথে। পরকালের অনন্ত জীবনের কথা বেমালুম ভুলে যায়, ইহকাল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ধর্মকে ব্যবহার করে ইহকালের ভোগের হাতিয়ার হিসেবে। ধর্মের নামে চলে ইহকালে ভোগের ব্যবসা। ধর্মের নামে কেমন ব্যবসা চলছে সকলের জানা আছে। এই তো গত সপ্তাহে পাশের একটি গ্রামের যুবকরা মিলে চাঁদা তোলে একটা ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করলেন, ওয়াজের যাবতীয় খরচ ও ওয়ায়েজীনদের হাদিয়া দেওয়ার পরও কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। সেই টাকা নাকি ওয়াজ আয়োজনকারী যুবকরা ভাগ বন্টন করে নিয়েছেন। এটা ধর্মের নামে ব্যবসা নয় কি? এছাড়া মসজিদ মাদ্রাসার ফান্ড সংগ্রহের জন্য বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করেন … এখানে চাঁদা উত্তোলনকারী, মাহফিল পরিচালনাকারী এবং ওয়ায়েজীনদের হাদিয়া এবং সম্মানীর নামে কিছু ব্যবসা থাকলেও মেনে নেওয়া যায় … মসজিদ মাদ্রাসার ফাণ্ড সংগ্রহ বড় কথা। কিন্তু যখন কোন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল দলের ফাণ্ড সংগ্রহ করতে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করে তখন সেটাকে ধর্মের নামে ধান্ধাবাজী বা ব্যবসা না বলে কি বলার আছে। শুধু মুসলমানরা নয় … এখন বিভিন্ন পূজা পার্বণের নামে অন্যান্য ধর্মের যুবকরাও মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে চাঁদাবাজি করতে দেখা যায়। চাঁদাবাজি করে ধর্মীয় মাহফিলের আয়োজন করা কতটা যুক্তিযুক্ত কিংবা ধর্ম কতটা সমর্থন করে সেটা আমার বোধগম্য নয়। তবে আমার মতে এটা উচিৎ নয়। কারন এই চাঁদা কেউ স্বেচ্ছায় দেয় না … কেউ লজ্জায় পড়ে দেয়, কেউ হয়তো সম্মানের খাতিরে দেয়। পিচনে গিয়ে অনেকে ক্ষোভ বিরক্ত প্রকাশ করে। বেটারা আর কাম পায়না … ধর্মীয় মাহফিলের চাঁদা তোলে। ধর্মের জন্য যদি এতই দরদ থাকে নিজের পকেটের টাকা দিয়ে মাহফিল করনা। একটা ধর্মীয় মাহফিল করতে কত খরচ হবে। ধর্মমতে ধর্ম প্রচার করা ধর্মের অনুসারীদের দায়িত্ব … এই দায়িত্ব পালন করতে কোন বিনিময় নিতে পারবে না। এই বিনিময় জমা থাকবে পরকালের সঞ্চয় হিসেবে। তবে ধর্মের কাজের মধ্যে যেটাকে পেশা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় … যেমন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা, মসজিদে ইমামতি ইত্যাদি পেশাদারী চাকরীতে বিনিময় নেওয়া যায়। বর্তমান মানুষ ধর্মীয় জীবনে এবং জাগতিক জীবনে দুটোতে চলছে উল্টো রথে … যেটা ভোগ করার কথা সেটা ত্যাগ করছে … যেটা ত্যাগ করার কথা সেটা ভোগ করছে। অতএব, ভবিষ্যৎ জিরো ০০০০০০০। দুটোই অর্থহীন।
ধর্ম নিয়ে

মানুষের সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা হচ্ছে ধর্মীয় অনুভূতি। যে যে ধর্মে বিশ্বাসী সেই ধর্মের স্থান তার কাছে তার নিজের জীবনের চাইতে অনেকখানি বেশী । ধর্মের জন্য নিজের জীবন দিতে কুন্ঠাবোধ করে এরকম মানুষ হয়তো খুব কমই পাওয়া যাবে । কিন্তু ইদানিং কালে কিছু মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় যাহারা নিজ ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলে । অথচ তখনো সে নিজেকে আবার সেই ধর্মের বলে দাবি করে । নিজের ধর্মের প্রতিটি বিষয় পালন করা তার জন্য দায়িত্ব ও কর্তব্য জানা সত্ত্বেও যে সব বিষয় তার কাছে কঠিন মনে হয় তার বিরুদ্ধে লিখতে কুন্ঠিত হয় না । বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ । এখানকার প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান । সুতরাং এখানে ডানপন্থী রাজনৈতিক/অরাজনৈতিক দল থাকাটা অবশ্যম্ভাবী । বরং না থাকাটাই হবে অপূর্ণতা । আর আমরা বাংলার কিছু স্বাধীন জনগন এসব দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধাচরণ করা নিজের দায়িত্ব মনে করে আর ধর্মীয় আলোচনা সামনে আসলেই ভাবতে শুরু করি আমাদের সংস্কৃতি আমাদের কালচার কে আমরা কেমন করে ১৫০০ বছর পিছিয়ে নেই? অথচ সেই ১৫০০ বছর আগের কালচার ছিল মুসলমানদের সেরা কালচার , তখনকার মানুষগুলোও ছিল মুসলমানদের ইতিহাসের সেরা মানুষ । যা আর চাইলেও কখনোই ফিরে আসবে না । ধর্ম আমাদের কি শিক্ষা দেয় নি ? একজন মুসলমান ধর্ম থেকে কি পায় নি? জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব কিছু লেখা আছে ধর্মের মধ্যে । অথচ আমরা বরই পন্ডিত হয়ে গেছি যে ধর্ম বাদ দিয়ে সবকিছু নতুন করে ভাবতে শুরু করেছি । ধর্মীয় দিক্ষা গুরুদের অবহেলা করা নিজেদের স্বভাবে পরিনত করেছি । কিন্তু সত্যিকারের শান্তি ও কামিয়াবি কখনোই মিলবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা ধর্মকে ভালোভাবে আকড়ে ধরবো ।
জামায়াতে কাতার সোজা ও ফাঁক না রাখা

জামায়াতে সালাত আদায়ের সময় অনেকেই কাতারে ফাঁক রেখে দাঁড়ায়। কারো কারো মনোভাব এমন, মসজিদে কি জায়গার অভাব আছে? অবস্থা এমনই বেগতিক যে, জামায়াতে সালাত আদায়ের সময় কখনো কখনো ২-৩ জনের মাঝে আরেকজন অনায়াসে ঢুকতে পারে। সচেতন কেউ কেউ এভাবে কাতারের মধ্যেও ঢুকে থাকেন। আসলে বিষয়টি মসজিদে জায়গার অভাবের প্রশ্ন নয়, জামায়াতে সালাত আদায়ের সময় দু’জনের মাঝে কাতারে ফাঁক না রাখা হচ্ছে রাসূল সা:-এর সুন্নাহ পালন করা।ক. কাতার সোজা করার গুরুত্ব: রাসূল সা: সমবেতলোকদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনবার বললেন, ‘তোমরা তোমাদের কাতারগুলো সোজা করো। আল্লাহর কসম! অবশ্যই তোমরা তোমাদের কাতারগুলো সোজা করে দাঁড়াও। অন্যথায় আল্লাহ তোমাদের অন্তরে মতানৈক্য সৃষ্টি করে দেবেন।’ (আবু দাউদ: ৬৬২)খ. কাতার সোজা করে দিতেন ‘রাসূল সা: কাতারেরএকপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে গিয়ে আমাদের বুক ও কাঁধ সোজা করে দিতেন, আর বলতেন, তোমরা কাতারে বাঁকা হয়ে দাঁড়িও না। অন্যথায় তোমাদের অন্তরে বৈপরীত্য সৃষ্টি হবে। (আবু দাউদ: ৬৬৪)গ. কাতার সোজা করার পর তাকবির: ‘আমরাসালাতের জন্য দাঁড়ালে রাসূলুল্লাহ সা: আমাদের কাতারগুলো সোজা করে দিতেন। এরপর সাহাবারা সমান্তরালভাবে দাঁড়িয়ে গেলে তিনি তাকবির বলতেন।’ (আবু দাউদ: ৬৬৫)ঘ. কাতার সোজা করা সালাত পূর্ণ করার অন্তর্ভুক্ত:‘তোমরা তোমাদের কাতারগুলো সোজা করো। কারণ কাতার সোজা করা সালাত পূর্ণ করার অন্তর্ভুক্ত।’ (ইবনেমাজাহ: ৯৯৩, আবু দাউদ: ৬৬৮)ঙ. কাতারে দু’জনের মাঝে শয়তানের জন্য ফাঁকা না রাখা: আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, উভয়ের (দু’জনের) মাঝখানে ফাঁক বন্ধ করো। শয়তানের জন্য কাতারের মাঝখানে (দু’জনের মাঝখানে) ফাঁকা জায়গা রেখে দিও না।’ (আবু দাউদ: ৬৬৬)চ. ফাঁকা জায়গায় শয়তান প্রবেশ করে: ‘হাদিসেআল্লাহর রাসূল সা. বলেন, তোমরা (সালাতের) কাতারগুলোতে মিলেমিশে দাঁড়াবে। ওই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার জীবন! আমি চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছি, কাতারের খালি (ফাঁকা) জায়গাতে শয়তান যেন একটি বকরির বাচ্চার ন্যায় প্রবেশ করছে।’ (আবু দাউদ:৬৬৭, নাসাঈ: ৮১৫) ছ. কাতার মিলালে আল্লাহর রহমত লাভ, মর্যাদা বৃদ্ধি:‘শয়তানের জন্য কাতারের মাঝখানে ফাঁকা জায়গা রেখে দিও না। যে ব্যক্তি কাতার মিলাবে (ফাঁক রাখবে না) আল্লাহও তাকে তাঁর রহমত দ্বারা মিলাবেন। আর যে ব্যক্তি কাতারে ফাঁক রাখবে, আল্লাহও তাকে তাঁর রহমত থেকে কর্তন (বঞ্চিত) করবেন।’ (আবু দাউদ: ৬৬৬,নাসাঈ: ৮১৯)‘যারা কাতারগুলো মিলিয়ে রাখে তাদের প্রতি আল্লাহ এবং তাঁর ফিরিশতারা রহমত বর্ষণ করেন। যে ব্যক্তি কাতারের ফাঁক বন্ধ করে, আল্লাহ তার বিনিময়ে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন) (ইবনে মাজাহ: ৯৯৫) লেখক: দিদার উল আলমশিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক