৫ই অক্টোবর, ২০২৫, ২০শে আশ্বিন, ১৪৩২

পরীমনির যত বিয়ে যত প্রেম!

পরীমনির আসল নাম শামসুন্নাহার স্মৃতি। নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ২০১১ সালে ঢাকায় আসেন। মডেলিং দিয়ে শুরু করেছিলেন যাত্রা। মিডিয়ায় আসার আগেই বিয়ে হয় তার। প্রেম ও বিয়ে – মাসুদ নামের এক আত্মীয়ের সঙ্গে প্রথম প্রেম ও পরে বিয়ে হয় পরীমনির। নানার বাড়ি বরিশাল থেকে মাসুদের সঙ্গে পালিয়ে চট্টগ্রামে চলে যান। ১ মাস পর আবারও বরিশালে ফিরে আসেন। এরপর বিচ্ছেদ হয় মাসুদের সঙ্গে। ২০১৪ সালে পরীর সঙ্গে পরিচয় হয় প্রযোজক (কথিত) নজরুল ইসলাম রাজের। এরপর থেকে রাজের সঙ্গী ছিলেন তিনি। শোনা যায় একসঙ্গে থাকতেন তারা। ২০১৬ সালের একটি ফেসবুক আইডি থেকে কিছু ছবি শেয়ার দিয়ে বলা হয়, পরীমনি ইসমাইল নামে একজনের স্ত্রী। ইসমাইলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। এরপর ফেসবুকে পাওয়া যায় সৌরভ কবীর নামের আরও একজনের সঙ্গে তার বিয়ের কাবিননামা- ঘনিষ্ঠ ছবি। শোনা যায় নাটকে অভিনয় করার সময় সেতু নামের এক ফটোগ্রাফারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। সংসারও করেছিলেন কিছুদিন।২০১৭ সালে তামিম হাসান নামে এক সাংবাদিকের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। বাগদানও হয়েছিল। দুই বছর প্রেমের পর ২০১৯ সালে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়। ২০২০ সালের ৯ মার্চ কামরুজ্জামান রনি নামে একজনকে বিয়ে করেন এই নায়িকা। ৫ মাসের মাথায় তাদের ছাড়াছাড়ি হয়। এরপর সাকলায়েন নামে ডিবির এক কর্মকর্তার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ কিছু ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়। বলা হয় তারা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। পরীমনির ঘনিষ্ঠতায় পদ হারিয়েছিলেন তিনি। সর্বশেষ চিত্রনায়ক শরিফুল রাজের সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন জনপ্রিয় নায়িকা পরীমনি। ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর রাজকে বিয়ে করেন। সে বিয়েও শেষ পর্যন্ত টিকল না। আজ বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) ডির্ভোসের কথা জানান পরীমনি। যদিও রাজ এ বিষয়ে এখনও কিছু জানাননি। ২০০৭ সালে পরীমনির মা আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু নিয়ে রহস্য রয়ে গেছে। মায়ের মৃত্যুর পর বাবার সঙ্গে সাভারে বসবাস শুরু করেন পরীমনি। ২০১২ সালে সিলেটে তার বাবার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষ তাকে খুন করেছে বলে জানা গেছে। বাবার মৃত্যুর পর পরীমনি সাভারে তার এক খালার বাসায় আশ্রয় নেন।

‘গদর ৩’ ছবিতে আমিশা?

‘গদর-২’ সিনেমার মাধ্যমে দীর্ঘ ২২ বছর পর আবারও সাফল্যের মুখ দেখেছেন একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী আমিশা প্যাটেল। ‘কহো না প্যায়ার হ্যায়’ সিনেমার পর অভিনেত্রীর ক্যারিয়ারে ধস নামে। একের পর এক সিনেমা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। ব্যক্তিগত জীবনেও বড় ধাক্কার মুখে পড়েন অভিনেত্রী। এবার ‘গদর ৩’ সিনেমা নিয়ে আসছেন নির্মাতা অনিল শর্মা। সেখানে থাকবেন আমিশা প্যাটেল। এবার “হদর ৩” দেখা যাবে ভারতীয় চলচিত্রে জনপ্রিয় অভিনেত্রী আমিশা প্যাটেলকে।

৫-১০ বছরের করণীয় ঠিক করা হচ্ছে: সংস্কৃতি উপদেষ্টা

চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। “আমরা যে অল্প কদিনের সরকার, আমাদের পক্ষে এটা রিস্ট্রাকচারিং করা খুব কঠিন কাজ। এটার জন্য ইলেকটেড গভর্নমেন্ট লাগবে।”৫-১০ বছরের করণীয় ঠিক করা হচ্ছে: সংস্কৃতি উপদেষ্টা চুয়ান্ন বছরের ‘জঞ্জাল’ অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে দূর করা সম্ভব না বলে মন্তব্য করেছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তবে পাঁচ-দশ বছরে কী করা উচিত, তার একটি পথনকশা তৈরি করা হচ্ছে বলে জানিযেছেন তিনি। সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। চট্টগ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয় নেই জানিয়ে এক সাংবাদিক মতামত জানতে চাইলে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুরী বলেন, “আমি আপনার সাথে একমত। আমরা যেভাবে স্ট্রাকচারগুলো করেছি আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর- শিল্পকলা একাডেমি, আর্কিওলজি মিউজিয়াম এমনকি মন্ত্রণালয় নিজে- স্ট্রাকচারগুলো কিন্তু এই আধুনিক সময়ের চাহিদা মেটানোর জন্য তৈরি করা হয় নাই। “আমরা যে অল্প কদিনের সরকার, আমাদের পক্ষে এটা রিস্ট্রাকচারিং করা খুব কঠিন কাজ। এটার জন্য ইলেকটেড গভর্নমেন্ট লাগবে। পাঁচ বছরের টার্মেও পারবে কিনা জানি না। পরপর দুই মেয়াদে যদি একই সরকার থাকে, তারা যদি বোঝে যে দেশের জন্য এটা ভালো, সেটা আমার কনটিনিউ করা উচিত, তাহলে সেই চেঞ্জ আসবে।” চট্টগ্রামের মুসলিম ইনস্টিটিউট এখনো চালু না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, “এটা নির্মাণাধীন। শেষ হবার পরে বুঝতে পারব কখন খুলে দেওয়া যাবে। আমাদের সকল মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন দর্শন হলো- দালান বানাও। দালানের ভিতর কী হবে, আর খবর নাই। “শিল্পকলা একাডেমির বহু জায়গায় এমন অনেক অডিটোরিয়াম আছে যেখানে ৫০ জন লোকও যায় না। মাসে পাঁচবারও ব্যবহার করা হয় না। সেখানে মাসে কয়েকটা প্রোগ্রামও হয় না। আমাদের কারিকুলাম নিয়ে কোনো ভাবনা নেই।” মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “যে জঞ্জাল গত ৫৪ বছরে জমেছে, আমাদের এই অল্প দিনে তা দূর করা সম্ভব না। তবে আমরা অনেকগুলো কাজ করছি। একটা ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করছি যে আগামী ৫ বছরে কী করা উচিত, ১০ বছরে কী করা উচিত। “আমরা যাবার আগে একটা প্রেস কনফারেন্স করব ‘রোড টু সাকসেসর’। আমাদের পরবর্তী পর্যায়ে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবে, আমার উপলব্ধি আমি নোট আকারে দিয়ে যাব। উনি যদি ফিল করেন এখান থেকে উনার নেওয়ার মত কিছু আছে, তাহলে উনি নিবেন এবং আশা করি দেশের কাজে লাগাবেন।” ফিরছে ‘নতুন কুড়ি’ শিশুদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি নির্মাণে সরকার কোনো উদ্যোগ নেবে কি না এমন প্রশ্নে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “এখন বললেই বলা হবে যে, গত ১৫ বছরের কথা বলা হচ্ছে। এতদিন আমরা শুধুমাত্র পাসের হার বাড়িয়েছি, আমরা শুধু দেখেছি কতজন জিপিএ ৫ পায়। “যখন শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলি, টের পাই, আমাদের শিক্ষা এবং সংস্কৃতির ফাউন্ডেশন ভয়াবহভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। এটা ঠিক করার জন্য সময় লাগবে। কাজ শুরু করতে হবে।” তিনি বলেন, “শিক্ষা উপদেষ্টা এবং তথ্য উপদেষ্টার সাথে কয়েকবার আলোচনা করেছি। তাদের সঙ্গে ‘নতুন কুড়ি’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এক সময় নতুন কুড়ি ক্রেজ তৈরি করেছিল। এটা চালু হলে একটা প্রভাব পড়বে। “আর স্কুলের কারিকুলাম একটা মেজর জিনিস। আমরা তো অল্প কদিনের সরকার। নির্বাচিত সরকার আসলে শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে টোটালি তাকানোর সময় অঅসবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটার কাজ কী এবং আমরা ইউনিভার্সিটি থেকে কী প্রডিউস করতে চাই, এটা মাথায় রেখে পুরো ব্যবস্থা নতুন ডিজাইন করার সময় চলে এসেছে।” জিয়া স্মৃতি জাদুঘর হবে ‘পূর্ণাঙ্গ মিউজিয়াম’ চট্টগ্রামের জিয়া স্মৃতি জাদুঘর ঘিরে পরিকল্পনা জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, “জিয়া স্মৃতি জাদুঘর গত ১৬ বছর প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল। মন্ত্রণালয়ে তিন মাস আগে এক সভায় এর বাজেট বরাদ্দ দ্বিগুণ করা হয়েছে। আজ পরিদর্শন করেছি। শুধু বরাদ্দ বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ না। এটা পূর্ণাঙ্গ মিউজিয়ামে রূপান্তর করা হবে। এর জন্য প্রয়োজন প্রপার কিউরেটর। “শুধু চট্টগ্রাম পর্ব না জিয়াউর রহমানের পুরো জীবন, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনায় উনি কী কী করেছেন সবগুলো জিনিসই আসার কথা। কিউরেশন টিম আমরা তৈরি করছি। পাশাপাশি তাদের সহযোগিতার জন্য একটা রিসার্চ টিম করব। তারপর রেনোভেশন করা হবে। এটার কাজ আমাদের মেয়াদেই শুরু করা হবে।” চট্টগ্রাম পুরাতন সার্কিট হাউজ। এখানে রয়েছে জিয়া স্মৃতি জাদুঘর। সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলেছেন, এটিকে পূর্ণাঙ্গ জাদুঘরে রূপ দেওয়া হবে। অনুষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জাহিদুল কবির কচি বলেন, “পুরাতন সার্কিট হাউজের (জিয়া স্মৃতি জাদুঘর) সামনের মাঠে পার্ক উচ্ছেদ করে এখন হাসপাতাল করা হবে বলে শুনছি। চট্টগ্রামের মানুষ ইতিমধ্যে প্রতিবাদ জানিয়েছে। অবিলম্বে এটা বন্ধ করেন।” জবাবে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “আমি ডিসি সাহেবের কাছ থেকে এটা জানলাম। এটা মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা অবগত আছেন। আমি এটা নিয়ে ঠিক জায়গায় যেন আলোচনার একটা রাস্তা শুরু হয়, সেটা বলব। ডিসি সাহেব জানালেন যে, এটার সামনে যে গ্রিন এরিয়াটা আছে এটাকে শিশুপার্ক করে পুরোটা একটা কম্পাউন্ডের মধ্যে (জিয়া স্মৃতি জাদুঘরসহ) এই প্রস্তাবটাও আমি ঢাকায় গিয়ে আলোচনা করব।” জুলাই স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, “আমরা জুলাই স্মৃতি জাদুঘরের একটি কেন্দ্রীয় কাজ করছি। সেখানে চট্টগ্রামও রিফ্লেকটেড হবে। আস্তে আস্তে বিভাগীয় শহরেও কাজগুলো যাবে।” বলী খেলা ও সাম্পান বাইচ আয়োজনে মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “আমরা অল্প কয়কদিনের সরকার। আমাদের মূল কাজ হলো বড় স্কেলে কিছু কাজ করা সাংস্কৃতিক প্যারাডাইম শিফটের ক্ষেত্রে। আপনারা দেখতে পেয়েছেন এবারের নববর্ষ স্বাধীনতার পরে সবচেয়ে বড় এবং ইনক্লুসিভ উৎসব হয়েছে। “মূল কাজ সংস্কৃতিটা যেন বাংলাদেশের সবার সংস্কৃতি হয়ে উঠে। এর একটা বড় দিক হচ্ছে উৎসব। উৎসব একটা জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক এক্সপ্রেশন হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে একটা বড় উৎসব জব্বারের বলী খেলা। চট্টগ্রামের নাম বললেই এই ছবিটা ভাসে। আরেকটা হলো সাম্পান বাইচ। গত ১৯ বছর ধরে চলছে। চট্টগ্রাম কল্পনা করা খুব কঠিন সাম্পান ছাড়া।” তিনি বলেন, “উৎসব শুধু উৎসব না, যা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে লিংকআপ করতে পারি। এরকম জিনিসগুলোর একটা তালিকা আপাতত শিল্পকলা একাডেমিকে করতে বলেছি। তালিকা হলে তা ন্যাশনাল ক্যালেন্ডারে যুক্ত হবে। “স্থানীয় পর্যায়ে যারা এগুলো করেন তারা কারো সহযোগিতার জন্য বসে থাকেন না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে এগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করা। জব্বারের বলী খেলা যারা আয়োজন করেন তাদের সাথে গতরাতে সভা হয়েছে। আগামী বছর থেকে এই আয়োজনের সঙ্গে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ও যুক্ত হবে। বাংলাদেশের কালচারাল হেরিটেজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ক্যালেন্ডারে যুক্ত হবে। সাম্পান বাইচের সাথেও আমরা যুক্ত হব।” সারাদেশের এ ধরণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকা ও সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়া হবে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, এ কাজগুলো আমরা করে দিয়ে যাব। পরে যারা সরকার পরিচালনায় আসবেন তারা কনটিনিউ করবেন বলে বিশ্বাস।” সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম, জব্বারের বলী খেলা ও সাম্পান বাইচের আয়োজকরা উপস্থিত ছিলেন।

সংস্কৃতি মানেই আমরা: বোধ, বিজ্ঞান ও বহুমাত্রিক জীবনচর্চা

সংস্কৃতি মানে শুধু রীতি নয়, এটি জীবনের পরতে পরতে লুকানো এক মহাজ্ঞানতন্ত্র। বিজ্ঞান, ধর্ম, এবং ইতিহাসের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমরা নিজেরাই এক মানচিত্র—চিন্তার, টানাপোড়েনের, জটিলতার। ছবি: এআই সংস্কৃতি কি শুধু উৎসব, নাকি এটি আমাদের জ্ঞান, বিশ্বাস আর অস্তিত্বের গভীরতম মানচিত্র? এক কথায় উত্তর হয় না, বিজ্ঞানের সূত্র, ধর্মের দৃষ্টি আর জনপদের গল্প—সব মিলিয়েই গঠিত হয় মানুষের চেতনার জটিল জ্যামিতি। আমেরিকার এক লাইব্রেরিতে কাজ করছিলাম। একজন বৃদ্ধা আমার হিসাব কষার দক্ষতায় অভিভূত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এত দ্রুত হিসাব করলে কীভাবে?’ আমি বললাম, ‘আমরা বাংলায় ছোটবেলা থেকেই সংখ্যাতত্ত্বের এমন সব পদ্ধতি শিখি, যা হাতে-কলমে এবং মাথায় করা যায়। ক্যালকুলেটর লাগে না।’ তিনি বিস্ময়ে বললেন, ‘এটা তো একেবারে মাইন্ড ম্যাজিক!’ কিন্তু এটা কোনো জাদু না, বরং আমার সংস্কৃতির ফল। এই ঘটনা আমাকে ভাবিয়েছে: আমরা যা করি, যেমন করে ভাবি, জীবন যাপন করি—সবই আমাদের সংস্কৃতির প্রতিফলন। সংস্কৃতি মানেই আমরা। আমরা কেবল সংস্কৃতির বাহক নই, বরং সংস্কৃতির স্রষ্টাও বটে। সংস্কৃতি হলো একটি জটিল, বহুস্বরী, পরিবর্তনশীল ব্যবস্থা যা আমাদের জ্ঞানচর্চা, ধর্মীয় বিশ্বাস, বিজ্ঞানচর্চা, আর নিত্যপ্রয়োজনীয় অভ্যাস দ্বারা গঠিত। সংস্কৃতি একটি জটিল ও অভিযোজিত ব্যবস্থাপনা সংস্কৃতি কখনোই একরৈখিক বা স্থির কিছু নয়। এটি একটি জটিল অভিযোজ্য ব্যবস্থা (Complex Adaptive System), যেখানে বহু উপাদান পরস্পরের সঙ্গে আন্তঃক্রিয়া করে এবং নিজেদের আচরণ পরিবর্তন করে। এই উপাদানগুলো স্থানীয় নিয়ম অনুসরণ করে, তবে তাদের সম্মিলিত কার্যকলাপ থেকে উদ্ভূত হয় বৃহৎ প্যাটার্ন। পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে এদের। জীববৈচিত্র্য, সমাজ, বাজার ও জলবায়ু এমন ব্যবস্থার উদাহরণ। যেমন সংস্কৃতি, যা মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, বিশ্বাস ও প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত ও পরিবর্তনশীল। ক্লিফোর্ড গিয়ার্টস সংস্কৃতিকে বলেছেন ‘a web of significance’, (গুরুত্বের জাল) যেখানে প্রতিটি অভ্যাসের পেছনে রয়েছে একটি বিরাট জাল যার বুনন অর্থ ও অর্থবোধ তৈরিতে কাজ করে। অর্থাৎ, প্রতিটি সাংস্কৃতিক চর্চাই কোনো এক বিশ্বাস, জীবনদর্শন বা পরিস্থিতির প্রতিফলন। সংস্কৃতি হলো মানুষের তৈরি অর্থপূর্ণ অর্থের জাল। মানুষ নিজেই এই জালে নিজেকে জড়ায় এবং এই জাল বোঝার মাধ্যমে আমরা একটি সমাজের অর্থ ও আচরণ ব্যাখ্যা করতে পারি। গিয়ার্টজ মনে করেন, সংস্কৃতি বিশ্লেষণ মানে হলো অর্থের স্তরগুলো ব্যাখ্যা করা—এটি একটি ব্যাখ্যামূলক বিজ্ঞান, কেবল আচরণ নয়, তার পেছনের অর্থ বোঝা। সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাও বলছে যে সংস্কৃতি শুধু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আনা সিং, মনিকা গ্যাগ্লিয়ানো ও পিটার ভোলোবেন তাদের নিজ নিজ কাজে দেখিয়েছেন, উদ্ভিদ ও প্রাণীদের মধ্যেও আছে সংস্কৃতিমূলক আচরণ—সম্পর্ক, শিক্ষণ ও প্রতিক্রিয়া। গাছেরা একে অপরকে রাসায়নিক বার্তা পাঠিয়ে সতর্ক করে; মাছেরা গ্রুপের মধ্যে আচরণ শেখে। অথচ পাশ্চাত্য বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে প্রাণী ও উদ্ভিদকে কেবল ‘automaton’ (যার প্রাণশক্তি মূলত যান্ত্রিক, অর্থাৎ যে নড়াচড়া করে কেবল প্রাকৃতিক নিয়মের বশবর্তী হয়ে, সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় না) হিসেবে দেখা হয়, সেখানে এই সম্পর্কের জটিলতাকে অস্বীকার করা হয়। পবিত্র ও অপবিত্রের বিভাজন: পশ্চিম ও প্রাচ্যের দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাত এমিল ডুর্খেইম তার সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে পশ্চিমা সংস্কৃতির একটি মূল দ্বৈততা তুলে ধরেন—পবিত্র (sacred) ও অপবিত্র (profane)। এই ধারা পশ্চিমা ধর্মতত্ত্ব ও জীবনদর্শনে দৃঢ়ভাবে গাঁথা। পশ্চিমা ইতিহাস ও সংস্কৃতির নিজস্ব ঐতিহ্যে পশ্চিমা সমাজতত্ত্ব দুনিয়াবি জগৎ, যেমন অর্থনীতি, রাজনীতি, সংসার ইত্যাদিকে ঈশ্বর, চার্চ বা অতিপ্রাকৃতিক শক্তির আওতা থেকে পৃথক করেছে। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই মানুষকে বা নিজ জাতিকে কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ধরার ঐতিহ্য জারি রেখেছে। কিন্তু প্রাচ্যতাত্ত্বিক চিন্তাধারায় এই রৈখিক বিভাজন প্রায় অনুপস্থিত। হিন্দুধর্মে বেদান্ত ও তন্ত্র দর্শনে সংসার ও সাধনা একে অপরের বিপরীত নয়; বরং পরিপূরক। বৌদ্ধধর্মে প্রতীত্যসমুৎপাদ—অর্থাৎ সম্পর্কের ভিত্তিতে সৃষ্টির দর্শন—একটি মৌলিক নীতি। ইসলামেও, কুরানে আল্লাহ বলেন: ‘প্রতিটি সৃষ্ট জীবকেই আমি এক জাতিরূপে সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা আন-আম, ৬:৩৮) সাঁওতালদের মতে, আদিতে কিছুই ছিল না—না আকাশ, না মাটি, না সময়। তখন শুধু ছিলেন ঠাকুর জিউ, যিনি দুটি হাঁস, হাড়াম ও হাড়ামিকে সৃষ্টি করেন। তারা ভেসে বেড়ায় এক বিস্তীর্ণ আদিসাগরে। পরবর্তীতে, জিউ সৃষ্টি করেন জমিন, পাহাড়, গাছপালা। হাড়াম ও হাড়ামি মিলিত হয়ে ডিম পাড়ে, আর সেই ডিম থেকে জন্ম নেয় বিভিন্ন প্রাণী, মানুষ, ও অন্যান্য জীব। এই কাহিনিতে মানুষ, গাছ, পশু-পাখি—সব এক সাধারণ উৎস থেকে উদ্ভূত। সাঁওতাল বিশ্বাসে প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান আত্মীয়, এবং তাই তারা প্রকৃতিকে পূজনীয় আত্মীয় মনে করে। রাজবংশী কোচদের একটি প্রাচীন সৃষ্টি গল্প অনুযায়ী, প্রথমে ছিল এক বিশাল জলরাশি। সেখান থেকে উদ্ভূত হন বড়ো ঠাকুর। তিনি প্রথম সৃষ্টি করেন মাটি, তারপর গাছপালা ও পশুপাখি। এরপর একদিন, মাটির বুক থেকে গড়ে তোলেন মানুষের আকার। এই মানুষ প্রথমে নির্বাক ও নিঃসচল ছিল। গাছের পাতার দোল এবং পাখির গান শুনে সে কথা শিখে, নাচে। এই গল্পে মানুষ প্রকৃতি থেকে শিখে—অর্থাৎ, মানবজ্ঞান প্রকৃতিজ্ঞান থেকে উদ্ভূত। রাজবংশীরা বিশ্বাস করেন, প্রকৃতি আমাদের শিক্ষক এবং আমরা তারই একটি অংশ। এটি স্পষ্টতই সম্পর্কনির্ভর একটি সৃষ্টিতত্ত্ব, যেখানে মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখি, উদ্ভিদ, এমনকি অদৃশ্য সত্তাও সৃষ্টির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। বিজ্ঞানও সংস্কৃতির অন্তর্গত সচরাচর বিজ্ঞানকে সংস্কৃতির বাইরে, এক ধরনের subject-neutral truth (বিষয় বা ব্যক্তি নিরপেক্ষ সত্য) বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু,টমাস কুন তার Structure of Scientific Revolutions (বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের অবকাঠামো)-এ দেখিয়েছেন যে, বিজ্ঞানও একটি নির্দিষ্ট, সময়, সমাজ ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যেই বিকশিত হয়। ‘Paradigm Shift’ (দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন) ধারণার মাধ্যমে তিনি বলেন, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানও এক ধরনের সামাজিক ঐকমত্য ও ঐতিহ্যের ফল। ব্রুনো লাটোর এবং স্টিভ উলগার তাদের ‘Laboratory Life’ (গবেষণাগারের জীবন) গ্রন্থে প্রমাণ করেন যে, বিজ্ঞান হলো এক ধরনের সাংস্কৃতিক অভ্যাস—যেখানে ভাষা, রীতি, ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞানকে গঠন করে। অর্থাৎ বিজ্ঞান, ধর্ম ও শিল্প—সবই সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় প্রতিফলন। সংস্কৃতির সঙ্গে বিজ্ঞানের পটপরিবর্তন একাদশ শতকের গোড়ার দিকে, ফাতেমি খলিফা আল-হাকিম বি-আমরুল্লাহ শুনলেন, এক বিজ্ঞানী দাবি করছেন যে তিনি নীল নদীর প্লাবন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। তিনি ছিলেন বসরা-নিবাসী হাসান ইবন আল-হাইসম, যিনি দর্শন ও প্রকৌশলে অভিজ্ঞ ছিলেন। খলিফা তাকে কায়রোতে আমন্ত্রণ জানালেন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিলেন। ইবন আল-হাইসম দক্ষিণ মিসর ঘুরে বুঝলেন, তার পরিকল্পিত বাঁধ তৈরি তখনকার প্রযুক্তিতে অসম্ভব। কিন্তু খলিফা ছিলেন খামখেয়ালি—ব্যর্থতা মানে মৃত্যু। ইবন আল-হাইসম নিজেকে রক্ষা করতে পাগলের ভান করলেন। ফলে তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয় কায়রোতেই। এই বন্দিত্বেই তিনি লেখেন তার যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘কিতাব আল-মানাযির’ (Book of Optics বা আলোর বই)। সেখানে তিনি পর্যবেক্ষণ, অনুমান, পরীক্ষা ও ফলাফল বিশ্লেষণ—এই চার ধাপে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূচনা করেন। হাসান হাইপথেসাইজ করেন যে আলো সরলরেখায় চলে, তাই প্রতিবিম্ব উল্টো হয় এবং এই সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে তিনি তৈরি করেন ‘লা লান্তেরনা ম্যাজিকা’ বা জাদুলণ্ঠন, যেটা ছোট একটা বাক্সের ভেতর বস্তুর উল্টো প্রতিবিম্ব তৈরি করত। এই ঘটনাটা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি, কারণ এর মাধ্যমে একটি প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তার ভিত্তিতে কোনো প্রাকৃতিক ঘটনাকে পুনরাবৃত্ত করতে পারার মধ্যে দিয়ে , প্রাকৃতিক জগতের ওপর মানুষের প্রত্যক্ষ প্রভাব সৃষ্টির উপায় তৈরি হয়। ইবন আল-হাইসমের কাজ দেখায় যে বিজ্ঞান কেবল গবেষণাগারে নয়, রাজনীতি, আতঙ্ক ও নৈতিক সিদ্ধান্ত থেকেও জন্ম নিতে পারে। কেবল তাই নয়, বিজ্ঞান পদ্ধতিতে আল-হাইসামের এই

সংস্কৃতির শেয়াল ও বাংলা একাডেমির ভাঙ্গা বেড়া

বাংলা একাডেমি সংস্কারে যে কমিটি গঠন করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, সেই কমিটি কতটা আইন মেনে হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ভাষা আন্দোলনের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া বাংলা একাডেমি দিনে দিনে এমন এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, যেখানে অধিকাংশ মহাপরিচালকই ছিলেন রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং চেয়ারের প্রতি অতিশয় অনুগত। ফলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও নিয়োগদাতা দলকে খুশি রাখতে তোষামোদকে সাহিত্যে পরিণত করেছেন তারা। লেখক ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলা একাডেমি সংস্কারের জন্য একটি কমিটি তৈরি হয়েছে এ মাসের ৭ জুলাই। এই কমিটি তৈরি করেছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যে মন্ত্রণালয়টি বেশ কিছু দিন ধরে নিত্যই বিতর্কিত হচ্ছে—কখনও বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান নিয়ে, কখনও বা শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদত্যাগ ঘিরে। এমনকি চলচ্চিত্র অনুদানের মতো বিষয়েও, যেখানে মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্ব নেই, সেখানেও তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ১৯৮৯ সালের আইনে শিল্পকলা একাডেমিকে একটি ‘সংবিধিবদ্ধ সংস্থা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেই আইনে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, “শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ পরিচালনা ও প্রশাসন একটি পরিষদের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং পরিষদ সেই সব ক্ষমতা প্রয়োগ ও কাজ করতে পারবে, যা একাডেমি কর্তৃক প্রযুক্ত ও সম্পন্ন হইতে পারে।” কিন্তু বর্তমানে মহাপরিচালকের পদ খালি থাকায় একাডেমি কার্যত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে পরিষদকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি পরিষদের সভাপতি এবং আইন অনুযায়ী সভা আহ্বানের দায়িত্বও তার ওপর ন্যস্ত। অথচ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি মাত্র একবার সভা ডেকেছিলেন, যেখানে আইন অনুযায়ী প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তত একটি সভা হওয়ার কথা। বিশেষ প্রয়োজনে অতিরিক্ত সভা ডাকার এখতিয়ারও তার রয়েছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদের পদত্যাগ বড়সড় আলোড়ন সৃষ্টি করলেও উপদেষ্টা কোনও সভা ডাকেননি। বরং বিগত চার মাসে একাডেমিকে আরও বেশি করে মন্ত্রণালয়ের করায়ত্ত ও তল্পিবাহক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগে দীর্ঘদিন মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল—তিনি নানাভাবে দুর্নীতি করেছেন এবং একাডেমির পরিষদকে কোনো গুরুত্বই দেননি। একই অবস্থা বাংলা একাডেমির। বাংলা একাডেমি আইনেও বলা আছে, ‘একাডেমির সর্বময় কর্তৃত্ব সাধারণ পরিষদের ওপর ন্যস্ত থাকবে। সাধারণ পরিষদ একাডেমির কার্যাবলি তদারকি ও পর্যালোচনা করবে এবং নির্বাহী পরিষদকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেবে।’ কিন্তু বাংলা একাডেমি সংস্কারে যে কমিটি গঠন করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, সেই কমিটি কতটা আইন মেনে হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, ফেলো, জীবন সদস্যদের অনেককে না জানিয়েই কমিটি করা হয়েছে। কমিটিতে কয়েকজন সদস্য হয়েছেন; যারা একাডেমির সাধারণ সদস্যও নন। তাদের নিয়ে বাংলা একাডেমি সংস্কার কমিটি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বাংলা একাডেমির স্বায়ত্তশাসিত চরিত্র নষ্ট করার প্রক্রিয়া অবশ্য আরও আগে থেকেই চলে আসছে। মন্ত্রণালয় নানাভাবে বাংলা একাডেমিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। বর্তমানেও এর ব্যত্যয় ঘটছে না। বাংলা একাডেমির সংস্কার কমিটি নিয়ে দুবার সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। কিন্তু আহূত ওই সম্মেলনগুলো কার্যত ভেস্তে যায়, কারণ সাংবাদিকদের উপস্থিতিই ছিল না বললেই চলে। ফলে দুই মাস পেরিয়ে গেলেও সংবাদ সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমেই সংস্কার কমিটির নাম প্রকাশ করতে বাধ্য হয় মন্ত্রণালয়। সংস্কার কমিটির নাম ঘোষণা নিয়ে বিতর্কের কিছুদিন আগে আমরা লক্ষ্য করেছি, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে এবার যে চলচ্চিত্র অনুদান ঘোষণা করা হয়েছে, তা নিয়েও বিতর্ক উঠেছে। বিতর্ক থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রেহাই মিলেনি। অনুদান কমিটির সঙ্গে যুক্ত লোকজনও অনুদান পেয়েছেন। একদিনে ৯৫জন আবেদনকারীর সাক্ষাৎকার নিয়ে ‘ইতিহাস’ গড়েছে অনুদান কমিটি। ফলে অনুদানের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনুদান কমিটি থেকে তিনজন সদস্য বিভিন্ন সময় পদত্যাগও করেছেন। পরে সেখানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দপ্তর নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক লতিফুল ইসলাম শিবলীকে অনুদান কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শিবলী মূলত গীতিকবি। নজরুল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হয়েও তিনি কি করে নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন, তা নিয়েই যেখানে প্রশ্ন আছে। এমনকি, চলচ্চিত্র অনুদান কমিটিতেও তাকে যুক্ত করা হয়েছে। অথচ তিনি তো চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞও নন। শিল্পকলা একাডেমি থেকে নজরুল ইনস্টিটিউট পর্যন্ত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ নিয়ে খুব কথা না হলেও, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়া বাংলা একাডেমিতে হস্তক্ষেপে সর্বদাই বিরক্ত হয়েছে মানুষ। যদিও বাংলা একাডেমিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ ও ছড়ি ঘোরানো নতুন কিছু নয়। নানা সময়ে তারা সুযোগ পেলেই এই কাজটা করেছে। কেবল মনজুরে মওলা, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, হারুন-উর রশীদ, সৈয়দ আনোয়োর হোসনে ও শামসুজ্জামান খানের সময়ে এই কাজটি করতে তারা সাহস পাননি। উল্লিখিত প্রথম দুজনের প্রখর ব্যক্তিত্বের সামনে হস্তক্ষেপ তো দূরের কথা, ওরকম কিছু ভাবারও সাহস করেনি মন্ত্রণালয়। শামসুজ্জামান খানের সময় করতে পারেননি শেখ হাসিনার সঙ্গে তার সুসম্পর্কের কারণে। এ যাবৎ একাডেমির বেশিরভাগ মহাপরিচালকই ছিলেন রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত, ফলে তারা সারাক্ষণ পদ হারাবার ভয়ে নিয়োগদাতা রাজনৈতিক দল ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তোষামোদ করে চলেছেন। বিএনপি আমলে নিয়োগ পাওয়া মহাপরিচালকরাও ওরকমটি করেছেন, আর সর্বশেষ আওয়ামী আমলের শামসুজ্জামান খান, হাবিবুল্লাহ সিরাজী ও মুহম্মদ নূরুল হুদা নির্লজ্জভাবে সেটা করেছেন বলেই দৃশ্যমান হয়। শামসুজ্জামান খান মন্ত্রণালয়ের কাছে মাথা নোয়াননি বটে, তবে শেখ হাসিনাকে খুশি করার জন্য বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, দুধের শিশু রাসেলকে নিয়েও অপ্রয়োজনীয় বহু বই বের করেছেন। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, মুহম্মদ নূরুল হুদাই বাংলা একাডেমিকে সবচেয়ে বেশি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ‘ঘেটু’ বানিয়েছেন। আশা করা গিয়েছিল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে গুণগত পরিবর্তন আসবে। কিন্তু তা আসেনি। বাংলা একাডেমির ওপর রাজনৈতিক ক্ষমতার বদল ঘটেছে মাত্র, এর চরিত্রের বদল ঘটেনি মোটেই। তা যে ঘটেনি, তারই প্রমাণ এই কমিটি গঠন। মোহাম্মদ আজম রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুবাদে মহাপরিচালক হয়েছেন। তিনি কি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এই হস্তক্ষেপ ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন? এই হস্তক্ষেপ মোহাম্মদ আজমের জন্য যেমন অসম্মানজনক, তেমনি বাংলা একাডেমির জন্যও অবমাননাকর। বাংলা একাডেমি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্র তথা নিজস্ব বিধি ও নীতিমালা রয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এখানে হস্তক্ষেপ বা খবরদারি করার কোনো সুযোগই নেই। কিন্তু তারপরও এই সুযোগ নিয়োগপ্রাপ্ত মহাপরিচালকরাই করে দেন পদ ও ক্ষমতার লোভে। বাংলা একাডেমির যদি কোনো সংস্কার প্রয়োজন হয়, তা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার নিজের ভেতর থেকেই ঘটা উচিত, মন্ত্রণালয় থেকে ওই কাজটি করা উচিত নয়। এতে বাংলা একাডেমির সার্বভৌম বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ণ হয় এবং তা প্রতিষ্ঠানটির জন্য অসম্মানের। তাছাড়া, বাংলা একাডেমির আদৌ সংস্কারের প্রয়োজন আছে কিনা—প্রশ্ন সেটাও। কেন মনে হলো এই প্রতিষ্ঠানের সংস্কার প্রয়োজন? কারণ বাংলা একাডেমি তার নির্ধারিত কাজগুলো করছে না। ক্ষমতাসীন দল ও ব্যক্তিবর্গের তোষামোদ করতে গিয়ে একাডেমি তার কর্তব্য থেকে সরে গেছে অনেকদিন আগে থেকেই। কিন্তু একাডেমি যদি মেধাবী ও প্রতিভাবান লেখকদের গবেষণাকর্ম, গুরুত্বপূর্ণ মননশীল গ্রন্থ প্রকাশ, অনুবাদ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে সঠিক ভূমিকাটি পালন করত, তাহলে এই সংস্কারের প্রশ্নটি দেখা দিত না। অর্থাৎ, একাডেমি তার নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করছে না বলেই, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মনে হয়েছে, এর সংস্কার দরকার। কিন্তু বিষয়টা যে সংস্কারের নয়, বরং একাডেমির কর্তব্যগুলো স্মরণ করিয়ে দেওয়ার—এই কথাটা আমরা ভুলে যাচ্ছি কেন? সংস্কার করলেই এই প্রতিষ্ঠান ভালোভাবে চলবে? এমন নিশ্চয়তাই বা কোথায়! মহাপরিচালক যদি তার দায়িত্ব পালন না

  • 0
  • 0
© 2025 Dhumketu . All Rights Reserved. || Created by FixiFite WEB SOLUTIONS.